১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এ অবস্থাকে বলা যায় সংহতির বা একাত্মতার সংকট। হিন্দু ও মুসলিম দুই পৃথক জাতি, এই দাবি ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রধান যুক্তি। দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজে পাকিস্তানের স্বাধীনতার কয়েকদিন পরেই গণপরিষদে বললেন, 'মুসলিম-হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ কিংবা পাঞ্জাবি-বাঙালি-সিন্ধি-পাখতুন পরিচয় ভুলে সকলকেই এখন এক পাকিস্তানি হতে হবে।' কিন্তু সেই পাকিস্তানের ঐক্যসূত্র তৈরি করতে গিয়ে পাকিস্তানের নেতারা ইসলাম ও উর্দুভাষার উপর জোর দেন আর অন্যান্য ধর্ম ও ভাষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এমনকি বাংলাভাষার সমৃদ্ধ সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ-মাইকেল-বঙ্কিমের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের প্রতি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বৈরী অবস্থান গ্রহণ করে।
বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ এদেশের অগ্রণী বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকরা বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে আসেন। এ সময়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একটি ভাষণে বলেছিলেন- 'আমরা হিন্দু বা মুসলিম যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই'।
পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রভাষা কী হবে? এ প্রশ্ন দেখা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন ও শিক্ষিত জনগণ তাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবি করে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্র-শিক্ষকদের সমাবেশে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, 'পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু'। উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীরা 'না না না' ধ্বনিতে এর প্রতিবাদ জানায়। দেশের শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অবস্থান নেন। পাকিস্তান গণপরিষদে বাঙালি সদস্য একাত্তরের শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। মুসলিম লীগের অনেক বাঙালি সদস্যও এই বিরোধিতায় যোগ দিয়েছিলেন। অথচ বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া ছিল যুক্তিযুক্ত। পাকিস্তানের তৎকালীন মোট জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৯০ লক্ষ। এর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ বাঙালি। বাকি আড়াই কোটি মানুষের মাতৃভাষাও উর্দু ছিল না।
দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভাষাকে সংখ্যাগুরু বাঙালির উপর চাপিযে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। বাঙালিরা কেবল বাংলা ভাষাকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেনি, তারা উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি চেয়েছিল।
মাতৃভাষার অধিকারের জন্যে এদেশে একাধিক উদ্যোগের কথা জানা যায়। এর মধ্যে রাজনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সমন্বয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনে তরুণদের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, গাজীউল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, শেখ মুজিবর রহমান, অলি আহাদ, আবদুল মতিন প্রমুখ।
১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষাব. দাবিতে সমগ্র দেশে ধর্মঘট ডাকা হলে শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অধিকাংশ নেতা গ্রেফতার হন। পুলিশের দমন-পীড়নে বহু ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়। এতেও ভাষার জন্য আন্দোলন কিন্তু বন্ধ হয় নি। এই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়। আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৫২ সালে ঢাকায় প্রাদেশিক-পরিষদের অধিবেশন বসলে ছাত্ররা গণপরিষদ ঘেরাও করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দিনটি ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি।
পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রদের বাধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। অর্থাৎ চারজনের বেশি একজোট হয়ে রাস্তায় মিছিল করতে পারবে না। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্ররা তা মানেনি। তারা মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় আপসহীন সাহসী ভূমিকা নিতে প্রস্তুত হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে সভা করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সেদিন আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে পুলিশ অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রথমে তারা লাঠিচার্জ করল ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল। তাতেও দমাতে পারল না বিক্ষোভকারীদের। মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আবদুল মতিন ও গাজীউল হক। এবার গুলি চালাল পুলিশ। গুলিতে শহিদ হলেন রফিক উদ্দিন, আব্দুল জব্বার এবং আবুল বরকত। আহতের সংখ্যা ছিল অনেক। তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে আবদুস সালাম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২২শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিলে শফিউর রহমানসহ নয় বছরের কিশোর ওলিউল্লাহও পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছিল। এছাড়া নাম না জানা আরও অনেকে ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারিতে নিহত হয়েছিল। তাঁরা সবাই ভাষাশহিদ।
যেখানে পুলিশের গুলিতে তাঁরা শহিদ হয়েছিলেন সেই স্থানে ২৩শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা তৈরি করে একটি শহিদ মিনার। ১৯৬৩ সালে এই অস্থায়ী মিনারটির স্থলে বড়ো করে শহিদ মিনার তৈরি করা হয়। এটিই ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে গড়া কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার।
বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করতে পেরেছিল। শেষ পর্যন্ত পূর্ববাংলার আইনসভা বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। অবশেষে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়। বাংলা এবং উর্দু দুই ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।
সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষার স্বীকৃতির ন্যায্য দাবি আদায়ে সফল হয়ে বাঙালির মনে জাতীয় চেতনা জোরদার হয়। বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করার সাথে সাথে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় বাঙালিরা।
ভাষার জন্য বাঙালির এই মহান আন্দোলনকে শ্রদ্ধা জানায় বিশ্ববাসী। ১৯৯৯ সালে আমাদের ভাষা আন্দোলন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তাই এখন প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিতে পৃথিবীর সকল জাতি নিজ নিজ মাতৃভাষাকে বিশেষ সম্মান জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। সেই সাথে স্মরণ করে ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের কথা।
কাজ-১: ভাষা আন্দোলনে শহিদদের ছবিসহ পরিচিতি লিখ। |
common.read_more